কলকাতার ভ্যাপসা গরম থেকে বাঁচতে দিনকয়েকের ছুটি হাতে পেলে চট করে ঘুরে আসতেই পারেন কেরলের স্বর্গরাজ্য মুন্নার থেকে...
দক্ষিণের গালিচায় মুন্নার.. লিখেছেন জয়িতা সরকার...
সবুজ কার্পেট, নীল আকাশ, সাদা মেঘের আনাগোনা, পিচ কালো রাস্তা, বাহারি জংলী ফুলে ভরা দক্ষিণের পাহাড়ি ছোট্ট শহরটি মন কাড়বে দেশ-বিদেশের যে কোন পর্যটকের। শরতের নীলাকাশ, সাদা মেঘ, পুজোর ছুটি ঘন্টা মানেই বেড়িয়ে পড়ার ডাক আসে। বাঙ্গালী-র হৃদয় জুড়ে তখন নদী- পাহাড়-সমুদ্রের হাতছানি। সেই বেড়িয়ে পড়ার টান উপেক্ষা করা যখন সাধ্যাতীত, অগত্যা বেড়িয়ে পড়তেই হল। এবারের গন্তব্য চা গালিচায় মোড়া পশ্চিমঘাট পর্বতশ্রেণির ভগবানের নিজের দেশের অন্যতম সুন্দর শহর মুন্নার।
দেশের পর্যটন মানচিত্রে স্বমহিমায় নিজেকে পরিচিত করেছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ কিংবা পূর্ব থেকে পশ্চিম সব প্রান্তের ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে মুন্নার পরিচিত। ভোর থেকে সন্ধ্যে মুন্নার-এর রূপ বদলায় প্রতি প্রহরে। বাহারি ফুল, চা-গালিচা, মেঘের খেলা, প্রথম রোদের ছটা, সব মিলিয়ে নৈসর্গিক মুন্নার। ছোট থেকে চা-এর শহরে বড় হলেও, দক্ষিণের এই বাগিচা শহর মন কেড়েছে অনেক বেশি। স্বাদে-গন্ধে দার্জিলিং-এর থেকে পিছিয়ে থাকলেও শৃঙ্খলিত বাগিচায় আর সবুজে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে এই শৈল শহরটি।
গরমের ছুটি মানেই বাঙ্গালির বেড়ানো, তবে বেশ কিছু বছর রাজ্যের বাইরে থাকায় সেই অভ্যেসে ভাঁটা পড়েছে, কিন্তু পিছুটান যাদের জন্য সেই বন্ধুরা যখন বলে, চল কোথাও একটা বেড়িয়ে পড়ি, তখন মনও বলে, 'বাজল ছুটির ঘন্টা।' চলো বেড়িয়ে পড়ি, তিন বন্ধু প্রায় দু'হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছল সিলিকন ভ্যালি অফ ইন্ডিয়া-তে, আমাদের বর্তমান ঠিকানা এখানেই। আমরা কর্তা-গিন্নি তো আগেই তৈরি।
আমরা পাঁচমূর্তি বেড়িয়ে পড়লাম মুন্নার-এর উদ্দেশ্যে। এবারের ট্রিপের বাড়তি উত্তেজনা ছিল সেল্ফ ড্রাইভিং, আমি নই, আমার কর্তার। মাঝ রাতেই বেড়িয়ে পড়লাম আমরা। গাড়ি ছুটছে হুসুর-ধর্মপুরী-কৃষ্ণাগিরি হয়ে সালেম এর দিকে। জাতীয় সড়ক -44 দিয়ে গাড়ি চলছে বেশ দ্রুত গতিতেই। পেছনে বসে থাকা এক বন্ধু বলে উঠল- ' আমরা longest highway দিয়ে যাচ্ছি।' শ্রীনগর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত এই পথ, বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি হল। সালেম পৌঁছতেই মুন্নার যাওয়ার রাস্তা দু'দিকে ভাগ হয়ে গেল। একটি আনামালাই রিজার্ভ ফরেস্ট এর মধ্যে দিয়ে, অন্যটি দিন্দিগুল হয়ে। দিন্দিগুল হয়ে মুন্নার পৌঁছতে বেশ কয়েক কিলোমিটার বেশি হলেও, পাহাড়ি পথ কিছুটা কম। আমরা সেই রাস্তাই ধরলাম। মাঝে বেশ কয়েকবার চা-এর বিরতি, হাসি ঠাট্টায় ঘুম খুব বেশি থাবা বসাতে পারেনি।
দিন্দিগুল ছাড়িয়ে থেনি-র কিছু আগে ইডলি, ধোসা-যোগে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার রওনা হলাম আমরা। থেনি পেড়িয়ে যেতেই কিছুটা চড়াই শুরু হল, পপ্পুরা পেড়িয়ে আরেকটু ওপরে উঠতেই পাহাড়ি গন্ধ ভেসে এলো, রাস্তায় হালকা মেঘের আনাগোনা, পাখিদের কিচিরমিচির জানিয়ে দিল, 'ওয়েলকাম টু হিল্স।' ঘন সবুজ জঙ্গলের মাঝে কালো পিচ রাস্তা, আর নিস্তব্ধতায় মোড়া চারিদিক প্রথমেই মন কেড়ে নিয়েছে। গাড়ি ছুটছে মুন্নার-এর দিকে, যতদূর চোখ যায়, শুধুই সবুজ। পাহাড়ের ঢাল ধরে সুসজ্জিত চা বাগান। সবাই যেন নিয়ম মেনে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে এখানে। কিছুটা যেতেই গ্যাপ রোড, যেই পথে না গেলে মুন্নারের সৌন্দর্য্য অধরা থেকে যায়। মসৃণ পথ, দু'ধারে সবুজ গালিচা আর দূরে পশ্চিমঘাট পর্বতের নীলাভ মহিমা।
আমাদের হোটেল ছিল মুন্নার মার্কেট-এর কাছেই। চার্চ-এর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেই রেইনবার্গ হোম-স্টে হল আমাদের দু-দিনের ঠিকানা। ফুল দিয়ে সাজানো ছোট্ট বাগান মন কেড়েছে প্রথম দেখাতেই। এজিলিয়া, দেব-কাঞ্চন ফুলে ভরা বাড়ির উঠোন। চটজলদি ফ্রেশ হয়ে, দুপুরের খাবার পর্ব সেরেই বেড়িয়ে পড়লাম পথামেদু ভিউ পয়েন্টের দিকে। আকাশে তখন মেঘের আনাগোনা, তাই তড়িঘড়ি আমরা রওনা হলাম আত্তুকাড ওয়াটার ফলস-এর দিকে। পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে জলরাশি। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে পা বাড়ালাম হোটেলের দিকে। ডিনার সেরে ঘরে যেতেই দু-এক পশলা বৃষ্টি, কিছুটা আতঙ্ক নিয়েই ঘুমোতে গেলাম, কি জানি কাল মুন্নার যদি মুখ ভার করে থাকে।
সকাল হতেই চার্চ-এর ঘন্টার আওয়াজ কানে এলো, এক ফালি রোদের ছটা দূরের পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে হোম-স্টে- এর উঠোনে। হালকা কুয়াশা আর রোদের মাখামাখিতে এক মায়াবি সকালের সাক্ষী হলাম আমরা। মনটাও বেশ খুশি, মুন্নার হাসছে। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে সাতটা। আমরা সবাই তৈরি, বেড়িয়ে পড়লাম টপ স্টেশনের উদ্দ্যেশ্যে। মুন্নার শহর থেকে টপ স্টেশনের দূরত্ব 34কিলোমিটার, অব্যক্ত এক সৌন্দর্য্য। একের পর এক চা-বাগানের অবর্ণনীয় রূপ, দূরের পাহাড়গুলো যেন আরও মোহময়ী করে তুলেছে মুন্নারকে। এই রাস্তা ধরে যেতেই পড়বে ফটো পয়েন্ট, মাত্তুপেট্টি ড্যাম, ইকো পয়েন্ট, কুন্ডালা লেক। আমরা প্রথমেই পৌঁছই টপ স্টেশন ভিউ পয়েন্টে, 20টাকা করে টিকিট কেটে মিলল টাওয়ার-এ ওঠার অনুমতি। চারিদিকে ওয়েস্টার্ন ঘাটের অপরূপ শোভা, মোহিত করবে সকলকে, বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে নেমে এসে ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম মাত্তুপেট্টি ড্যাম এর দিকে। ফিরতি পথে চোখে পড়ল ইন্দো-সুইস ডেয়ারি ফার্ম, তবে সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই, বেশ কিছুটা সময় এই পথে কাটিয়ে আমাদের এবারের গন্তব্য এরাভিকুলম ন্যাশনাল পার্ক। মুন্নার মূল শহর থেকে 8কিলোমিটার দূরে। পৌঁছাইতেই দেখি লম্বা লাইন, টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে তখন শুধু একটাই কথা ভেবে চলেছি, একবার যেন দেখা পাই।
170 টাকা করে প্রতিজনের টিকিট, আর ক্যামেরার জন্য 50টাকা, টিকিট কেটেই নিয়ম-নীতি পড়তে গিয়েই প্রথম চোখ আটকাল, তার দেখা পাওয়া নাকি নিয়মিত নয়, একটু মনটা খারাপ হল, এদিকে আকাশও তখন মুখ ভার করছে। সে যা হোক, বাসে উঠে বসতেই কুয়াশা ঘিরে ধরছে চারিদিকে। মূল পার্কের গেটের সামনে বাস থেকে নেমে হেঁটে উঠতে হবে অনেকটা। শুরু হল আমাদের যাত্রা, বহু রকমের ছোট বড় গাছে ভরা পাহাড়ের গা। হঠাৎই থমকে গেলাম, ওই তো ওপরে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা, ওদের দেখতেই তো এতদূর আসা। সেই নীলগিরি থার (nilgiri tahr )। দল বেঁধে নীচের দিকে নামছে ওরা। একটু আশঙ্কা থাকলেও জানা ছিল এদের দেখা মিলবে। পশু-পাখি আমাকে কখনও নিরাশ করেনি। চলল ফটো-সেশন। ঠান্ডা বাড়ছে, এবার নীচে নেমে আসার পালা। যদিও বিশেষ এই প্রাণীটিকে চাক্ষুষ করে মনে তখন উষ্ণ উন্মাদনা।
রাতে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম হোমমেড চকলেট কিনতে, সঙ্গে টুকিটাকি আরও কিছু। আজই শেষরাত এই সবুজ মলমল চা-এর গালিচা শহরে। তবে এখনও কিছুটা বাকি আছে, সকাল হতেই আবার গ্যাপ রোড। মুন্নার-এ আমাদের শেষ সকালের আকাশ ছিল নীলে মোড়া। আর তাতেই গ্যাপ রোডের শোভা বেড়েছে দ্বিগুণ। পুরো রাস্তায় দু' পাশে চা-বাগান আর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা হৃদয়ের ভ্রমণ কুঠুরিতে যত্নে রাখব কথা দিলাম।
কী কী দেখবেন:
রালার মন্ত্রমুগ্ধ ট্যুরিস্ট স্পট,
৩টি নদী কুণ্ডলী, মধুরাপুজা, নাল্লাথান্নির সঙ্গমস্থল, নিরালা, নির্জন, দুর্দান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য,
টি গার্ডেন, টপ স্টেশন, রাজমালাই ন্যাশনাল পার্ক, মাট্টুপেট্টি ড্যাম, রোজ গার্ডেন।
কোথায় থাকবেন :
দ্য লিফ মুন্নার, পারাক্কাট নেচার হোটেলস, স্যান্ডিস উইন্ডি উডস
কোথায় খাবেন:
সারাভানা ভবন, রাপসি রেস্টুরেন্ট, গুরুভবন
কিভাবে যাবেন :
কোচি এয়ারপোর্ট থেকে ১১০কিমি, রেল স্টেশন আলুভা
Comments